শনিবার ইজরায়েলে অতর্কিতে আক্রমণ চালায় হামাস। মৃত্যু হয় কমপক্ষে ৭০০ জনের। এই ঘটনা ফের একবার চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল যে দখল এবং অবরুদ্ধ করে রাখা প্যালেস্টাইন ভুখণ্ডের পরিস্থিতি কতটা অস্থির এবং ইজরায়েলের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগ যতই শক্তিশালী বলে দাবি করা হোক না কেন, হামাসের মতো নন-স্টেট অ্যাক্টর ইজরায়েলের জন্য কতটা বিপজ্জনক। বেশ কয়েক মাস ধরেই ওয়েস্ট ব্যাংকে উত্তেজনা বাড়ছিল। তবে কেউই আন্দাজ করতে পারেননি যে গাজা থেকে এরকম একটা সুপরিকল্পিত, লো-টেক হলেও নিষ্ঠুর আক্রমণ চালানো হবে। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ওয়েস্ট ব্যাংকে প্রতিদিনই হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। শনিবারের আক্রমণের আগে, শুধুমাত্র এই বছরই ২০০ প্যালেস্তিনীয় এবং ৩০ জন ইজরায়েলী নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। যদিও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার এই বিষয়টি নয়ে এতদিন ততটা মাথা ঘামায়নি। তারা নিজেদের দেশে বিচার বিভাগের সংস্কার সহ নানা অভ্যন্তরীণ নীতি পরিবর্তনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এদিকে ইজরায়েলের সেনাবাহিনী গাজা ভুখণ্ডের বর্তমান পরিস্থিতিকে “স্থিতিশীল অস্থিরতা” বলে বর্ণনা করেছে, যার মানে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হলেও তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যেই হামাস আক্রমণ চালিয়েছে। এই আক্রমণ অনেকটা ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সেবার মিশর এবং সিরিয়ার যৌথ শক্তির সামনে কেঁপে উঠেছিল ইজরায়েল। মূলত একটি ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন হিসাবে পরিচিত হামাস ১৯৯০-র দশকে এবং ২০০০ সালের প্রথম দিকে আত্মঘাতী আক্রমণ চালানোর জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এবারের ঘটনায় সাধারণ নাগরিক এবং সেনার মধ্যে তারা কোনো তফাৎ করেনি। নির্বিচারে আক্রমণ চালিয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইজরায়েলের ওপর এটি অন্যতম জোরালো আক্রমণ।
এই আক্রমণ থেকে বেশ কিছু নৈতিক এবং বাস্তববাদী প্রশ্ন উঠছে। হামাস যেভাবে নির্বিচারে ইজরায়েলী নাগরিকদের টার্গেট করেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। তাদের এই আচরণ মোটেও প্যালেস্টাইনের জন্য সহায়ক হবে না। এতে বরং প্যালেস্টাইনের অধিবাসীদের ইজরায়েলের আক্রমণের মুখে পড়ার ঝুঁকি আরও বাড়বে। অন্যদিকে ইজরায়েলও একই আচরণ করছে। তারাও নিজেদের পাল্টা আক্রমণে বাছবিচার করছে না। ইজরায়েল প্রতিপক্ষ শিবিরের মধ্যে ঢুকে নির্বিচারে আক্রমণ চালাচ্ছে। প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ নাগরিকেরও। আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দখল করে রাখা ভুখণ্ড হিসাবে পরিচিত প্যালেস্টাইনের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। সেখানে কোনো শান্তি প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নেই। ইজরায়েল ওয়েস্ট ব্যাংকে একের পর এক জনবসতি গড়ে তুলেছে, সিকিউরিটি ব্যারিয়ার এবং চেকপয়েন্ট তৈরি করেছে, প্যালেস্তিনীয়দের যাতায়াতের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে এবং সংগঠিত প্যালেস্তিনীয়দের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে বল প্রয়োগ করতে পিছপা হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে চলতে থাকা এই অচলাবস্থার জেরে প্যালেস্তিনীয়রা আরও বেশি চরমপন্থী হয়ে উঠেছেন এবং আরও শক্তিশালী হয়েছে হামাস। ইজরায়েল এবার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অতীতে গ্রাউন্ড অ্যাটাক এবং বিমান হামলা চালিয়েও হামাসকে খুব একটা দমানো যায়নি। পশ্চিম এশিয়াতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক সমীকরণও বদলে যেতে দেখা গিয়েছে। যেমন ইজরায়েল-আরব পুনর্মিলন, ইরান-সৌদি বন্ধুত্ব। তবে এই সমস্ত পরিবর্তনের পরেও প্যালেস্টাইন অবরুদ্ধ হয়ে থাকার সমস্যা অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সমস্যাটি জিইয়ে রাখা হয়েছে। তাই এর পরিণামও অনিবার্য। যদি ইজরায়েল এবং অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি অঞ্চলটিতে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি এবং স্থিতিশীলতা আনতে ইচ্ছুক হয়, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই প্যালেস্টাইন সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানের কথা ভাবতে হবে। মূল সমস্যার সমাধান না করে, শুধুমাত্র সামরিক অভিযান চালিয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না।
COMMents
SHARE