বাসে উঠে যদি সিট ফাঁকা পাওয়া যায়, ভিড় যদি একটু কম থাকে আর সেই সাথে যদি একটু ফুরফুরে হাওয়া বইতে থাকে, তাহলে কার না ভালো লাগে! তবে ভিড় বাসে উঠলে এরকম মজা পাওয়া যায় না। পরমাণুর চরিত্রটাও অনেকটা এরকম। পরমাণুকে কোনো পাত্রে, কম ঘনত্বের মধ্যে রাখলে তারা এক নির্দিষ্ট ধরনের আচরণ করে। আবার কম স্পেসে, বেশি ঘনত্বের মধ্যে রাখলে তাদের প্রতিক্রিয়া বদলে যায়। তখন তাদের আচরণে নতুন কিছু দেখা যায়। সেই নতুন বিষয়টা কী, তা আবিষ্কার করার জন্যই ২০২৩ সালে রসায়নে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে তিন বিজ্ঞানীকে। টেকনিক্যাল ভাষায় বলতে গেলে, কোয়ান্টাম ডট হিসাবে পরিচিত, মাত্র কয়েক ন্যানোমিটার প্রশস্ত ছোট ক্রিস্টালের আবিষ্কার এবং তা রিফাইন করার জন্য বিজ্ঞানীদেরকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কোয়ান্টাম ডটে কয়েক হাজার পরমাণু থাকে (যেখানে এক ফোঁটা জলের মধ্যে এক ‘সেক্সটিলিয়ন’ থাকতে পারে)। একটি ডটের মধ্যে পরমাণুগুলো গাদাগাদি করে থাকে বলে তাদের ইলেক্ট্রনগুলোও একে অপরের খুব কাছাকাছি থাকে। এই অবস্থাতে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মাবলী দিয়েই কোয়ান্টাম ডটের আচরণের বর্ণনা করা হয়। প্রভাব এতটাই জোরালো থাকে যে, গোটা ডটই একটা পরমাণুর মতো আচরণ করতে পারে। ডটগুলোর আর একটা বৈশিষ্ট্য আছে, যা মোটামুটি সবাই জানেন। কোয়ান্টাম ডটে যদি কিছুটা আলোর বিকিরণ করা হয়, তাহলে সেটি আলো শুষে নিয়ে, এটির আকার অনুযায়ী, আলোকে একটি পৃথক ফ্রিকোয়েন্সিতে (বা রঙে) পুনরায় নির্গত করবে। ডট ছোট হলে, তা থেকে তুলনামূলকভাবে উচ্চতর ফ্রিকোয়েন্সির (আরও বেশি নীল) আলো নির্গত হয় এবং ডট বড় হলে ঠিক এর উল্টো ছবি দেখা যায়। তাই কোনো মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি একটি কোয়ান্টাম ডট যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে, সেই একই মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি, তবে ছোট আকারের কোয়ান্টাম ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। এই সমস্ত কারণের জন্যই ট্রানজিস্টার, লেজার, মেডিকেল ইমেজিং এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে কোয়ান্টাম ডটের অনেক প্রয়োগ দেখা যায়। ১৯৮১ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে কর্মরত অ্যালেক্সেই একিমভ প্রথমে কোয়ান্টাম ডটকে একটি ফ্রোজেন গ্লাসের মধ্যে সিন্থেসাইজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার দুই বছর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ল্যুই ব্রাস একটি দ্রবণের মধ্যে কোয়ান্টাম ডটকে সিন্থেসাইজ করেন এবং তার কোয়ান্টাম-ফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ধারণ করেন। সব শেষে, ১৯৯৩ সালে মৌঙ্গি বাওয়েন্ডি আরও সহজে এবং নির্ভরযোগ্যভাবে উচ্চমানের কোয়ান্টাম ডট তৈরির একটা রাস্তা আবিষ্কার করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ড. ব্রাসের তত্ত্বাবধান ছাত্র জীবন থেকেই কোয়ান্টাম ডট নিয়ে বাওয়েন্ডি কাজ করা শুরু করেছিলেন। তাদের এই অবদানের জন্যই তাদেরকে রসায়নে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হলো।
বিজ্ঞানের যে কোনো আবিষ্কারের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, সেগুলোর সমস্ত টেকনিক্যাল বিশেষত্বের কারণে আদতে সেগুলো ক্ষতিকর নয় বা তা থেকে সমস্যা তৈরি হতে পারে না। কোয়ান্টাম ডট তেমনই একটা ব্যাপার। তাদের আচরণ বা প্রতিক্রিয়া বুঝতে গেলে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যাপারে বিশদ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স তাদের আচরণ নির্ধারণ করতে পারে না। ড. একিমভ নিজেই অপরিচ্ছন্ন গ্লাসের রঙ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এলইডি স্ক্রিনের আলো জ্বালাতে এবং টিউমার সরানোর আগে, সেটি কোথায় আছে, তা জানতে কোয়ান্টাম ডটের আলো সাহায্য করে। এর পাশাপাশি নানা রঙ, যেমন লাল, সবুজ এবং নীল অথবা অন্য যে কোনো রঙ, যা তাদের অনুপ্রাণিত করে, তা থেকে নজর সরিয়ে নেওয়া উচিত নয়।
COMMents
SHARE